এক পশলা বৃষ্টি




এক পশলা বৃষ্টি

শ্রাবণ মাস,কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল, মাটির সোদা গন্ধ তখনও ফিকে হয়ে যায়নি। আকাশের ঘন মেঘের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে স্বর্ণালী রোদ আলিঙ্গন করছে মাটির পৃথিবীকে, আর তারই মাঝে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির চুম্বন । এমনই শ্রান্ত বরষার স্নিগ্ধ সকালে সোনামুখী বাসস্ট্যান্ডে হেমন্তের সাথে প্রথম দেখা হয় শ্রাবণীর, তারপর অালাপ দুজনের। শ্রাবণী তখন অষ্টাদশী অার হেমন্ত বাইশ বছরের ফুটফুটে যৌবন।
সেদিন ২২ শে শ্রাবনের বিকেলবেলা, সোনামুখী নদীর নিরালা ঘাটে হেমন্ত শ্রাবণীকে বলল– “অামি তোমাকে ভালোবাসি। ” বর্ষার অশান্ত নদীর মতো চঞ্চল হয়ে উঠল শ্রাবণীর দুচোখ, স্নিগ্ধ গোলাপের পাপড়ির মতো মুখখানি রাঙা হয়ে উঠল তার।অষ্টাদশী বালিকার সারা শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায়। দুহাত দিয়ে মুখখানি লুকাবার ব্যার্থ চেষ্টা করে সে।নিজেকে কোনোমতে সম্বরণ করে লজ্জাশীলা শ্রাবণী নত মুখে বলল–“কেন ভালোবাসো অামায়..?”
“তোমাকে ভালোলাগে তাই ভালোবাসি ” — হেমন্তের উত্তরে শ্রাবণীর রমণী হৃদয় অারো কোমল, অারো চঞ্চল হয়ে উঠল। ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি এল, কালো মেঘের অালোর ঝলকানিতে সন্ধ্যা নামল দুচোখ ভরে। হেমন্ত আর শ্রাবণী বাড়ি ফিরল এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে। রাতে নিরালা ঘরে বিছানায় শ্রাবণী স্বপ্নালু চোখে অাঁকিবুকি কাটে বালিশে, আর ভাবতে থাকে হেমন্তের কথা।
এরপর রোজ পড়ন্ত বিকেলে লুকিয়ে দেখা করত, প্রেমালাপ হত দুজনের। কথা দেওয়া-নেওয়া, কেষ্টদার দোকানে চায়ের চুমুকে মনের কথা বলা,খুনসুটি অার স্বপ্ন দেখার মাঝে কখন যে দিন গুলো পেরিয়ে যেত তা দুজনের অজানা ছিল।
বর্ষা শেষ, আকাশে তখন ছন্নছাড়া মেঘের আনাগোনা, বাতাসে শিউলির গন্ধ, চারিদিকে কাশফুলের মেলা। কান পাতলেই শোনা যায় শরতের আগমনী সুর।
সেদিন বিকালে হেমন্ত শ্রাবণীকে বলল–” চলো, আমরা বাড়িতে আমাদের ভালোবাসার কথা জানাই।”
হেমন্তের এমন অপ্রত্যাশিত কথায় লজ্জা রাঙা নত মুখে শ্রাবণী জানায়–” এখন নয়,আর কিছুদিন যাক্।”
কিন্তু হেমন্তর যে আর তর সইছে না। তার মনে কেমন যেন একটা অজানা আশঙ্কা জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। আসলে হেমন্ত চায় শ্রাবণীকে বিয়ে করতে। কিন্তু বিয়ে করে শ্রাবণীকে নিয়ে সংসার বাঁধার স্বপ্ন কি সত্যি হবে তার? এখন সে বেকার। একটা চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত শ্রাবণীকে বিয়ে করার কথা ভাবাটা অনেক কঠিন। আর শ্রাবণীর পরিবার হয়ত কখনোই চাইবে না কোনো বেকার ছেলের সাথে তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে। যদিও হেমন্ত পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী, মেধার পরিক্ষায় সে ইতিমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেয়েছে সরকারি কলেজে। কিন্তু শ্রাবণীকে ছেড়ে যেতে মন চায় না তার।
সেদিন ছিল নবমীর শেষ সন্ধ্যা, মায়ের সাথে ঠাকুর দেখার ভীড়ে লালটুকটুকে শাড়ি পরা অষ্টাদশী বালিকা কে দেখে চোখ সরানোর উপায় ছিল না হেমন্তর।কালো মেঘের মতো দুখানি চোখ, সুন্দর পরিচর্যায় এলানো কেশ আর ভ্রু যুগল দেখে মনে হবে পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর উপমা যেন এখানে হার মানিয়ে যায়। হেমন্ত শ্রাবণীকে ইশারা করে তার সাথে দেখা করার জন্য। মায়ের চোখ এড়িয়ে নুতন বাহানায় শ্রাবণী দেখা করে হেমন্তের সাথে। ঈশ্বর বোধ হয় এখানেই এদের মিলন স্বাক্ষাতের যবনিকা ঘটান!! শ্রাবণীর দাদা দেখে ফেলে ওদের দুজনকে। তারপর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বকুনি, কঠোর শাসন।পরদিন বিজয়ার বিসর্জনে সানাইয়ের সুরে মুখরিত যখন আকাশ বাতাস, তখন একাকী বদ্ধ ঘরে ডুকরে কেঁদে ওঠে শ্রাবণীর মন।
প্রতিদিনের মতোই নদীর ঘাটে শ্রাবণীর অপেক্ষায় সময় গোনে হেমন্ত, কিন্তু শ্রাবণী আর আসে না। দিনের পর দিন এবাবে অপেক্ষায় রত হেমন্ত ঠিক করে শ্রাবণীর বাড়ি যাওয়ার। একদিক সকালে সে চলে যায় শ্রাবণীর বাড়ি।কিন্তু বাড়ির দরজায় মস্ত বড়ো তালা দেওয়া। এক প্রতিবেশীর কাছে জিজ্ঞাসা করায় সে জানায়- শ্রাবণীর পরিবার পাকাপাকি ভাবে একেবারের মতো চলে গেছে কলকাতায়। বুকে তীব্র যন্ত্রণা অার হতাশা নিয়ে বাড়ি ফেরে হেমন্ত। গভীর রাতে বিছানায় চিৎকার করে কাঁদতে চেষ্টা করে সে। তার চোখে ঘুম নেই, কতদিন ভেবেছে শ্রাবণীকে রাত্রির প্রহর গোনার প্রতীক্ষার অবসরে, কতবার অবাধ্য হয়েছে মন ভাবনার ফাঁকে ফাঁকে। তার চোখে শুধুই শ্রাবণের জলধারা। বেশ কিছুদিন পর দিল্লীর একটি কলেজে ভর্ত্তির চিঠি আসে হেমন্তর। আর হেমন্ত রওনা দেয় অনাকাঙ্ক্ষিত জীবনের দিকে। তারপর…………….
দীর্ঘ ছয় বছর অতিক্রান্ত, আজ ২২ শে শ্রাবন, এখন হেমন্তর জীবনে শ্রাবনের স্নিগ্ধ ধারা নেই। ছয় বছর পর হেমন্ত ফিরছে তার গ্রামের বাড়িতে। জীবনের বোহেমিয়ান ধারায় কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে হেমন্তের প্রেম।দিল্লীর একটি নামী কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রী নিয়ে কলকাতার একটি মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানিতে চাকরী পেয়েছে সে। তাইত আজ আত্মম্বর আশায় ঘরে ফেরার পালা। হেমন্ত জানে,আজ আর তার জন্য প্রতীক্ষা করে নেই সেদিনের সেই অষ্টাদশী বালিকা।অথচ তার মনে রয়েছে এক গূঢ় আশা।
কলকাতা থেকে রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার একটি বাসে উঠে জানালার সিটে বসে জীবনের হিসেব কষতে থাকে হেমন্ত। মনে পড়ে যায় ছয় বছর অাগে ঘটে যাওয়া তার জীবনের অফুরন্ত অধ্যায়ের কথা।স্মৃতির রোমন্থনে দ্রুত গড়িয়ে যায় বাসের চাকা।আজ তার কাছে কি নেই ? গাড়ি, বাড়ি, অর্থ সবকিছুই আছে তার। সফলতার চুড়ান্ত পর্বে এসে হেমন্ত হারিয়ে ফেলেছে তার শীতল, কোমল ভালোবাসা, শ্রাবণীর প্রেম কে। আজ সে উপলব্ধি করছে —- ” কল্পনার চেয়ে বাস্তবতা অনেক ভালো, অনেক মধুর।”
বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হেমন্ত দেখতে পায় সারি সারি গাছ গুলো সরে যাচ্ছে বহু দূরে। অার এভাবেই হয়ত দূরে গিয়েও ফিরে অাসবে ভালোবাসার তাগাদায়।বাসের তীব্র ঝাঁকুনি আর হর্নের শব্দে চেতনা ফিরল হেমন্তর। হঠাৎ বাস থামল, রাস্তার ধারে মাইলস্টোনে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে — ‘সোনামুখী ব্রিজ’
এক মুহুর্ত্বের জন্য বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে হেমন্তর। —–” ওই যে কেষ্টদার চায়ের দোকান, অাচ্ছা ওই যে টেবিলটা, যেখানে আমরা রোজ বসতাম, ওখানে আমাদের মতো অার কেউ বসে..? গল্প করে সারাক্ষণ..? ”
“ওই যে পালতোলা নৌকাটা, আমরা কতবার ওটাতে চড়েছি অার মাঝি অালি চাচার কাছে গল্প শুনেছি কত। অাচ্ছা, নৌকাতে অার কেউ ওঠে।” — হেমন্তর সবকিছু মনে পড়ে যায় নস্টালজিয়ায়।
” বাব্বা! কিচ্ছু পাল্টায় নি এত দিনেও”
শুধু পাল্টে গেছে হেমন্তের জীবন।বাসের জানালা দিয়ে হঠাৎ নদীর ঘাটের দিকে চোখ পড়ে যায় হেমন্তর। কোনো এক রমণী বসে রয়েছে আনমনে জীর্ণ ঘাটের থাম্বাটার উপর, ঠিক যেখানে হেমন্ত অার শ্রাবণী বসে থাকত। “কে ও.. অনেকটা শ্রাবণীর মতো। হ্যাঁ শ্রাবণীই তো..!”
“গাড়ি থামান প্লিজ “— চিৎকার করে বলে ওঠে হেমন্ত। সঙ্গে সঙ্গে বাসের ব্রেক কষার বিকট শব্দ, বাস থেমে গেল—- হেমন্ত পাগলের মতো দ্রুত নেমে এল ব্রিজের ধারে। তারপর ছুটতে ছুটতে নদীর ঘাটে।
“শ্রাবণী! সত্যি কি শ্রাবণী, নাকি মনের ভ্রম?”– নিজের মনে প্রশ্ন করে হেমন্ত। না, এতো সেদিনের সেই অষ্টাদশী বালিকা শ্রাবণী নয়, তবে কে..? অনেকটা শ্রাবণীর মতো..! এমন বিবশ বিবর্ণা রমণীকে কিছুতেই চেনা যাচ্ছে না। উত্তেজনায় ছটফট করে ওঠে হেমন্ত। নিজেকে সম্বরণ করতে না পেরে ডাক দেয় –” শ্রাবণী.. ” সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে তাকায় বছর চব্বিশের তরুণী। হঠাৎ করে হেমন্তকে দেখে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। উত্তেজনায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত কম্পন হতে শুরু করে তার। হেমন্ত কাছাকাছি অাসতেই তার মনে অনুরাগের মেঘ জমতে শুরু করে। নিজেকে অার সম্বরণ করতে পারে না শ্রাবণী। দৌড়ে গিয়ে হেমন্তকে জড়িয়ে ধরে সে। বলতে থাকে— ” কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি? একটা খবর পর্যন্ত নাওনি, তোমার জন্য রোজ প্রতীক্ষা করে এখানে বসে থাকি অামি।”শ্রাবণীর অভিযোগে হেমন্ত কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।দুহাত দিয়ে শ্রাবণীকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করে সে। এমনি করে তাকে অার কোনোদিন হারাতে দেবে না সে।
অদৃষ্টের কি বন্ধন! যে প্রতীক্ষা দীর্ঘ ছয় বছরের তা মাত্র কয়েক মিনিটে মিলিয়ে গেল জীবনের খরস্রোতায়। কয়েক মুহুর্ত্বের মধ্যে আকাশে কালো মেঘের গনঘটা অার তারই সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। হেমন্তের বুকে মাথা রেখে অঝোরে কেঁদে চলে শ্রাবণী। দুচোখে তার বিরহের মেঘ, বৃষ্টি এল দুচোখ জুড়ে। অার হেমন্ত জ্বলন্ত কাঠের মতো দাঁড়িয়ে জাপটে ধরে থাকে শ্রাবণীকে।
দূর থেকে ওদের দুজন কে দেখলে মনে হবে, কি অপূর্ব দৃশ্য! যেন চোখ জুড়িয়ে যায়! হেমন্ত কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি শ্রাবণীকে এভাবে ফিরে পাবে। আর শ্রাবণী প্রতীক্ষা করতে করতে সময়কে হার মানিয়ে দিয়েছে। আসলে জীবন এমনই সময়ের সাথে বয়ে চলে আপন খেয়ালে। বৃষ্টি থেমে গেছে, অাকাশে তখন রামধনুর সাতরঙার চ্ছটায় চারিদিক উদ্ভাসিত আর তারই মাঝে সাদা ঘন মেঘের উপর উড়ে যায় একঝাঁক পাখি কোনো এক অনির্দেশের পথে………..।
পলাশ হালদার

Comments

Popular posts from this blog