জীবন ও মৃত্যুর এক অনন্য অভিজ্ঞতা*



বেঁচে থাকার জন্য অামরা কত কিছু না করি। জীবনের প্রতিটা স্তরে অামরা লড়াই করে চলি বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবনে যখন এই লড়াইয়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় তখন মৃত্যুটাই কাম্য হয়ে ওঠে। শুভাকাঙ্ক্ষীরা চায় তার প্রিয়জন যেন সুখে শান্তিতে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে, কিন্তু সেই প্রিয়জন যখন জীবনের চলার গতি হারিয়ে ফেলে তখনই মৃত্যুই সেই শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে কামনার বস্তু হয়ে ওঠে। এমনই একটি ঘটনার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে নতুন করে জীবন ও মৃত্যুকে উপলব্ধি করলাম.........।জৈষ্ঠ্যমাসের প্রখর রৌদ্রস্নাত দুপুরে অামি অার অামার সহকর্মী হেমন্ত বেরিয়ে পড়লাম একটি সরকারি জনসচেতনতামূলক প্রকল্পের কর্মী হয়ে।এরই সুবাদে সুযোগ পেয়েছিলাম মানুষের কাছাকাছি অাসার। কয়েকদিন অাগে একটি গ্রামে গিয়েছিলাম কাজ অার ভালোলাগার তাগিদে। অার তখনই হাঁসফাঁস গরমে নাজেহাল হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু তবুও অামাদের কর্তব্য অার কাজের নেশাই অাশা জুগিয়ে চলছিল প্রকৃতির প্রতিবন্ধকতায়। মুলত মানুষের সুস্থ শারীরিক ও স্বচ্ছ পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করাই অামাদের উদ্দেশ্য ছিল। এমনই একটি বাড়িতে পৌঁছাতেই অামাদের কানে ভেসে এলো কয়েকটি শব্দ..... "ও মা!  ও বাবারে!  অামার মরন হয় না কেন?" কন্ঠটি এতটাই কাতর ছিল যে  অামরা হক চকিয়ে যাই। প্রতি মুহূর্তে  মনে হচ্ছিল এ যেন মৃত্যু পথযাত্রীর হাহাকার।কিছুক্ষণের জন্য অামি হারিয়ে গিয়েছিলাম মৃত্যুপুরীতে,  অামার সহকর্মীর ডাকে অামার চেতনা ফিরল। গৃহের গৃহস্বামী বেরিয়ে এলেন অামাদের সম্মুখে।  কিছু কথাবার্তার মাঝে জানতে পারলাম মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর কন্ঠটি তার মায়ের। এক মুহূর্তের জন্য ইচ্ছে হলো দেখার। গৃহস্বামীও অামাদের নিয়ে গেলেন সেই ঘরে। দেখলাম অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে অর্ধনগ্ন অবস্থায় তক্তপোশের উপর শুয়ে কাতরাচ্ছেন এক বৃদ্ধা।জানতে পারলাম তিনি ক্যানসারে অাক্রান্ত।রুগ্ন শরীরে মুখের কোঠর থেকে দুখানি কালো চোখ অামাদের দিকে চেয়ে রয়েছে অার অামি তাকাতে পারছিলাম না তার দিকে।তিনি বার বার অামাদের কাছে একটু বিষ চাইছিলেন।নিজের অজান্তেই অামার চোখে জল চলে এলো, জল চলে এলো অামার সহকর্মীর চোখেও। তারপর সেই মৃত্যুপথযাত্রীনি বৃদ্ধা সম্পর্কে অনেক কথাই শুনলাম। অার তখনই জীবন সম্পর্কে অামার এক অনন্য ধারণা তৈরী হলো।
 গৃহস্বামীর জন্মের পর তার পিতৃবিয়োগ ঘটে।তারপর থেকে তার মা নিঃসম্বল অবস্থায় জীবনের লড়াই চালিয়ে যান।  মাঠের কাজ করে, বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করে তিনি 'বাবু'কে লেখাপড়া শেখান।বলাবাহুল্য এই 'বাবু' হলেন বর্তমান গৃহস্বামী। উচ্চশিক্ষার গন্ডি পার করেও শুধুমাত্র ঘুষের টাকার অভাবে চাকরি হয়নি বাবুর অার তাই সংসারের হাল ধরার জন্য মাঠে শ্রমিকের কাজ করতে হয়। তারপর কয়েটা বছর, বাবুর বিয়ে, সংসার কাটছিল বেশ ভালোই।কিন্তু একটা সময় তার মায়ের শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে, তারপর দীর্ঘ পনেরো বছরের লড়াই..! যা কিছু সম্বল ছিল তার প্রায় সবই নিঃশেষ কিন্তু লড়াইটা অাজও থামেনি.....।যদিও লড়াইটা জীবনের পক্ষে নয়, মৃত্যুর পক্ষে। অার কখন যে বিজয়ী হবে সেকথা কেউ জানে না। সবটা বলার পর গৃহস্বামী একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এ কেমন জীবন! ছেলে মায়ের মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছেন!
অামরা বেরিয়ে পড়লাম গৃহস্বামীর বাড়ি থেকে। কিছুটা যেতেই অাবার সেই কন্ঠস্বর...!সেদিন অার কাজ করতে ইচ্ছে করছিলনা। ফিরে এলাম বাড়িতে, কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না......। বার বার মনে পড়ছিল রুগ্ন রোগগ্রস্ত বৃদ্ধার মুখখানি অার তার ছেলের কথা। রাতে বিছানায় শুয়ে গভীর ভাবনায় অাত্মমগ্ন হলাম কিন্তু ভুলতে পারলাম না। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নটাও ভেসে এলো চোখের সামনে-.. .. 
অামি দেখলাম বৃদ্ধাটি তার ছেলের কাছে একটু বিষ প্রার্থনা করছেন অার বলছেন-- " বাবু, অামার অমৃতের স্বাদ এনে দে।" এ অমৃত "মৃত্যু " এই মৃত্যুর স্বাদ পেতে চান বৃদ্ধা? অার তখনি গৃহস্বামী হাতবাড়িয়ে বিষের শিশি এগিয়ে দিচ্ছেন তার মায়ের দিকে।অার বৃদ্ধা তাঁর কাঁপা কাঁপা হাতে পান করছে শান্তির অমৃত।অামি বার বার চেষ্টা করছি বাধা দেওয়ার কিন্তু পারছিনা। " ওই যে ঢক ঢক করে বিষ পান করে চলেছে বৃদ্ধা অার অামি চেঁচিয়ে চলেছি.... কিন্তু ততক্ষণে বিষের শিশি খালি। না! অার কিছু করার নেই। ধীরে ধীরে প্রশান্তির অাভাস ফুটে উঠলো বৃদ্ধার মুখে।কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি তাঁর ছেলেকে বলছেন - "ভালো থাকিস বাবু!"
হঠাৎ অামার ঘুম ভেঙে গেল।চোখে মুখে ঘাম অার ভারী নিঃশ্বাস নিয়ে উঠে পড়লাম বিছানার উপর।বাইরে তখন পাখির কলতান, জানালাটা খুলতেই হালকা অালো অার সঙ্গে স্নিগ্ধ বাতাস অামার চোখে মুখে এসে পড়লো.....। প্রশান্তির স্নিগ্ধ সকালে নতুন করে উপলব্ধি করলাম জন্ম ও মৃত্যুর এক অনন্য অভিজ্ঞতা।  বুঝলাম- "সব মৃত্যুই যন্ত্রণার নয়, কিছু মৃত্যু শান্তির।"

                                             পলাশ হালদার

অামার লেখা একটি অভিজ্ঞতা। যদিও প্রথাগত লেখকদের মতো নয়। তবু কিছুটা চেষ্টা করলাম.....।

Comments

Popular posts from this blog